প্রকাশিত: Wed, Jan 11, 2023 7:12 AM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 3:16 AM

লিটফেস্ট থেকে ওয়াজ এবং মধ্যবর্তীগণ

আফসান চৌধুরী

[২] ঢাকা শহর ও ফেসবুক এখন গম গম করছে লিটফেস্ট নিয়ে। বিরাট আয়োজন, বিশ্বের নানা স্থান থেকে এসেছেন সেলেব্রেটিরা। এদের নাম আমরা দূর থেকে শুনেছি, পড়েছি বিশেষ করে যারা পশ্চিমা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত। অতএব এটা সেই চর্চার একটি উৎসবের আয়োজন। এটা নিয়ে কি কারও সমালোচনা করার কারণ হতে পারে? তবে হচ্ছে এবং বেশ জোরেসুরেই। কেবল কি বলছে সেটা নয়, কারা বলছে সেটাও। [৩] লিটফেস্ট বিরোধীদের মধ্যে একদল আছে যারা ইংরেজি সাহিত্য চর্চারই বিরোধী। তারা এটাকে ওপর তলার ইংরেজিপনা মনে করে, উন্নত মানসিকতার প্রকাশ। এরা মোটা দাগে এলিট বিরোধী অবস্থান থেকে কথাগুলা বলে, তাদের মতে। ইংরেজি কলোনিয়াল ও উচ্চবিত্তের ভাষা, অতএব বাংলা ভাষা চর্চা বিরোধী- যেটা কিনা মধ্যবিত্তের সংস্কৃতি। কিন্তু কারেন্ট বাংলা তো নিজেই জন্মেছিল কলোনিয়াল প্রয়োজনে। এর প্রথম মদদদাতা কারা?

[৪] বাংলাদেশে ইংরেজি চর্চার বিরোধী হওয়া কঠিন কারণ যেখানে ইংরেজি বিশ্বের ভাষা আর বাংলা এই আমরা কজনের। যে কারণে লাখ লাখ মানুষ ইংরেজি শেখে রুজির তাগিদে। বিসিএস পরীক্ষাতে এটা লাগে, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং শিখতে লাগে, গার্মেন্টস  বিক্রি করতে লাগে। দুনিয়ার সাথে কথা বলতে হলে ইংরেজি জানতে হবে। আবার এটাও ঠিক এই ইংরেজি চর্চা ভালো হয় বিদেশে অথবা ঢাকার বড়লোক স্কুলে। অর্থাৎ শ্রেণির ব্যাপারটাও আছে। কিন্তু ভাষাটা লাগে সবার।

[৫] ফেসবুকে অনেকে লিটফেস্টের টিকিটের দামের কথাটা তুলেছেন। সব ‘ফ্রি চাই’ কালচার যে দেশে এত প্রতিষ্ঠিত, সেখানে টিকিট থাকলেই প্রতিবাদ হবে। কিন্তু এক ফেস্ট কে নিন্দা জানানো আবার অন্যদিকে টিকিটের দামের সমলোচনা করা একটু খটকা লাগবেই। লিটফেস্ট যদি বড়লোকের হবে, অন্যরা যাবে কেন? তবে স্টুডেন্টদের জন্য আরও কম দামে টিকিট ছাড়া উচিত ছিল, সবখানে এটা হয়। কেউ কেউ বলেছেন যে ‘ইংরেজি উৎসবে আপত্তি নেই কিন্তু বাংলা একাডেমিতে টিকিট কেটে যাওয়া আপত্তিকর।’ কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একাডেমি তো বাংলা ভাষার জন্য কেবল, সেখানে ইংরেজি কেন?

[৬] বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ২১ দফার একটি দাবি ছিল। এটা ১৯৫২ সালের রাজনীতির ফসল ভাবা হয়। আসলে ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ থেকেই। তার দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে যেটা চলে যায় ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লগ্নে। বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক নয়। কেবল উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে বাংলা ভাষাভাষীরা চাকরি বাকরি থেকে সব বাদ পড়তো। শেখ মুজিব ও মওলানা ভাসানী দুইজনই এই আন্দোলন করেছেন। তারা সাংস্কৃতিক অবস্থান থেকে করেননি, করেছেন কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের বৈষম্য মূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে।

[৭] এই ‘আমরা কেবল  বাঙালি’ স্লোগানের ঐতহাসিক দিক থেকে সংকীর্ণ, প্রায় ‘মৌলবাদী’ মনে হয়। বাংলা একাডেমি হচ্ছে ভাষা সংস্কৃতির চর্চার পরিসর। তাতে বাংলা তো অগ্রে থাকবেই। কিন্তু কেবল বাংলা আর কেউ নয় কেন? যারা অনুমতি  দিয়েছে তারা একসময় অবশ্য লিটফেস্ট বিরোধী ছিলেন কেউ কেউ কিন্তু মানুষের ধারণা ভাবনা পাল্টায়।

[৮] যারা লিটফেস্ট কে গালি দিচ্ছেন তাদের কম বেশি সুশীল মধ্যবিত্ত বলে ধরা যায়। তারা সমাজের ওপর তলায় নেই বা কম, কিন্তু ওপরতলা নির্ভরশীল তাই এতটা সবল নয়। যাদের একসময় ‘প্রগতিশীল’ বলা হতো তাদের নজর দীর্ঘ কিন্তু নিজেরা সক্রিয় রাজনীতি বেশি করেননি বা করেন না। তারা নিজেদের অবস্থানকে লিটফেস্ট দ্বারা একটু থ্রেট মনে করেন।

[৯] আর যারা লিটফেস্ট করে তারা হচ্ছে ইংরেজ আমলের ‘বিলেত ফেরত’ পার্টি। ক্ষমতার কাছাকাছি, একে অন্যের সাথে যুক্ত। পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক ঘনিষ্ট নানাভাবে। তাদের সম্পর্ক স্থানীয় ওপর ও ইউরোপের মধ্যবিত্ত সুশীল গোষ্ঠীর সাথে। তারা দুনিয়ার সাথে যুক্ত অনেক বেশি তবে দেশকে বাদ দিয়ে নয় কারণ এখানেই তাদের খেলার মাঠ।

[১০] কিন্তু এক দল আছে যারা লিটফেস্ট নিয়ে মাথা ঘামায় না। না যাবার ইচ্ছা রাখে না গালি দেবার। খুব মোটা দাগে এরা হলো রেমিট্যান্স অর্থনীতি নির্ভর জন গোষ্ঠী যারা এ দেশের সবচেয়ে স্বাধীন গোষ্ঠী, মূল বাস ঢাকার বাইরে। তাদের সংস্কৃতি এ দেশের উচ্চ ও মধ্য বিত্ত উভয়ে অপছন্দ করে। এরা রবীন্দ্রনাথ বা শেক্সপিয়ার কম পড়ে। তাদের জীবনে ধর্মীয় সংস্কৃতি বড় ভূমিকা পালন করে। তারা ওয়াজ শোনে, কিছুটা বিশ্বাস করে কিন্তু তার চেয়ে বেশি মজা পায়। সোশ্যাল মিডিয়া তাদের দখলে। গ্রামীণ কালচার কেন্দ্রিক ভিডিও - ধর্ম হোক বা পরকীয়া, মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পায়। এই সব কিছু মিলেই তাদের লিটফেস্ট, একুশে বই মেলা ও চর্চা। এবং তারাই দেশের প্রধান জনগোষ্ঠী। লিটফেস্ট বাংলা একাডেমির ঝগড়া খুব ছোটখাটো পরিসরের বিষয় মনে হয়, খুব ঢাকা কেন্দ্রিক। আর মূলত বোধহয় নরম শরম শ্রেণি ঝগড়া। সবই ঠিক আছে, চলবে। লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক